8 September 2011

Autograph


অটোগ্রাফ
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন অটোগ্রাফের ব্যাপারটা জানতামই না! যখন ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে পড়ি, তখন বগুড়ায় বেগম সুফিয়া কামাল এসেছিলেন। আমরা মহা উৎসাহে তাঁকে দেখার জন্য স্টেশনে গিয়েছি। যখন ট্রেন এসেছে, তখন আমাদের আক্কেল গুড়ুম। স্টেশনে অসংখ্য মানুষ এবং বাচ্চাকাচ্চা। যাঁর জন্য এত উত্তেজনা, সেই বেগম সুফিয়া কামাল থার্ড ক্লাসের একটা বগিতে করে চলে এসেছেন (তখন ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস আর থার্ড ক্লাস ছিল!)। বেগম সুফিয়া কামালের নজরে পড়ার জন্য আমাদের ভেতর নানা রকম কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল—আমি তাঁর একটা বিশাল ছবি এঁকে সবাইকে টেক্কা দিয়ে ফেললাম। সেই ছবি মঞ্চের ওপর টাঙানো হলো এবং গর্বে আমার ছোট বুকটা এক শ হাত ফুলে গেল। তাঁকে নিয়ে আমাদের এত উত্তেজনা, কিন্তু আমার একবারও তাঁর একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার কথা মাথায় আসেনি (লোকজন শুনে হাসাহাসি করতে পারে। আমি তাঁর অটোগ্রাফ নিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরে—যখন আমার বয়স ৪০!)।
আজকাল আমাকেও অটোগ্রাফ দিতে হয়। যারা অটোগ্রাফ নেয়, তাদের অনেকে অটোগ্রাফশিকারি বলে। আমি শব্দটা পছন্দ করি না। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে অটোগ্রাফ দিই এবং যে ছোট ছেলেমেয়েরা অটোগ্রাফ নেয়, তাদের মোটেও হিংস্র শিকারির মতো মনে হয় না। তবে অটোগ্রাফ দেওয়ার বেলায় লেখকের একটু সতর্ক থাকা দরকার। কখনোই ধরে নেওয়া উচিত নয় যে পাঠকমাত্রই তাঁর বইয়ে লেখকের একটা অটোগ্রাফ চান। ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমি একবার অত্যন্ত বিচিত্র একটা দৃশ্য দেখেছিলাম। পাঠক বই কিনেছেন। লেখক বইয়ের স্টলে বসে আছেন। তিনি স্মিত হাসি হেসে বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে দিলেন। পাঠক তখন মহা খাপ্পা হয়ে চিৎকার করে বলল, ‘আপনি কেন আমার বইয়ে অটোগ্রাফ দিলেন? আমি কি আপনার অটোগ্রাফ চেয়েছি?’
লেখক আমার পরিচিত, তাই তাঁকে লজ্জা থেকে উদ্ধার করার জন্য কিছু দেখিনি, কিছু শুনিনি এ রকম ভান করে দ্রুত সরে পড়লাম।
যারা অটোগ্রাফ চায়, তারা সাধারণত একটা অটোগ্রাফ পেলেই খুশি। মাঝেমধ্যে কেউ চলে আসে, যারা সঙ্গে আরও কিছু চায়। যেমন একবার একজন এসে বলল, ‘স্যার, লিখে দেন, প্রিয় জরিনা, আলতাফ মিয়া তোমার হরিণ-কালো চোখে ডুব দিতে চায়। তারপর নিচে অটোগ্রাফ দিয়ে দেন। তারিখটা দেবেন এক সপ্তাহ পরের। তখন তার জন্মদিন। জন্মদিনে এই বইটা তাকে গিফট করব।’
আমি মাথা চুলকিয়ে বলি, ‘এক সপ্তাহ পরে যদি বেঁচে না থাকি? তা ছাড়া জরিনার চোখ হরিণ-কালো কি না, সেটাও তো জানি না। আলতাফ মিয়ার সেখানে ডুব দেওয়ার চেষ্টা করাটা ঠিক কাজ হবে কি না, সেটাও তো বুঝতে পারছি না।’ আলতাফ মিয়া আমার কথা শুনে বিরক্ত হলো এবং খানিকক্ষণ গাঁইগুঁই করে আমাকে রাজি করাতে না পেরে শুকনো একটা অটোগ্রাফ নিয়ে মুখ কালো করে বিদায় হলো।
কেন একজন আরেকজনের অটোগ্রাফ নেয় আমি সেটা খানিকটা অনুমান করতে পারি। তার কারণ, আমি নিজেও মাঝেমধ্যে অটোগ্রাফ নিয়েছি। শিওরলি ইউ আর জোকিং মিস্টার ফাইনম্যান নামে একটা অসাধারণ বই আছে। বইটি লিখেছেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়া রিচার্ড ফাইনম্যান। আমি যখন ক্যালটেকে কাজ করি, তখন তিনি সেখানে ছিলেন। আমি তাঁর থেকে একটা বইয়ে অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছিলাম। তখন যদি কেউ আমার কাছে বেড়াতে আসত, আমি তাদেরও তাঁর অটোগ্রাফ দেওয়া বই উপহার দিতাম। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বলে একটা কথা চালু আছে; সেই কথাটা চালু করেছিলেন হার্বাট সাইমন নামের একজন নোবেল বিজয়ী। আমার ছেলের একটা বিজ্ঞানের বইয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিয়েছি। রুডলফ মসবাওয়ার নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী আছেন, যিনি তাঁর পিএইচডি থিসিসের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমি যে গ্রুপে কাজ করতাম, ওই গ্রুপের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আমি তাঁর কাছ থেকেও বিশাল একটা বইয়ে অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের নিজেদের নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের শুধু অটোগ্রাফ নয়, তাঁর লেখা চিঠিও আমার কাছে আছে। কাজেই কেন একজন আরেকজনের অটোগ্রাফ নেয়, আমি সেটা খানিকটা অনুমান করতে পারি; তবে পুরোটা যে বুঝতে পারি, তা নয়। একটা উদাহরণ দিই—একবার গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়েছি। সেখানে অসংখ্য ছেলেমেয়ে। দুপুরের ছোট একটা বিরতিতে সবাই আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সামলানোর জন্য আমি শেষ পর্যন্ত দুটি লাইন করে দিলাম। একটি ছেলেদের আরেকটি মেয়েদের। লম্বা লাইন। তার মধ্যেই সবাই ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। ১০-১২ বছরের একটা মেয়ের ডায়রিতে অটোগ্রাফ দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, সেখানে আমার একাধিক অটোগ্রাফ রয়েছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তার মাঝে একটি অটোগ্রাফে আজকের তারিখ। তার মানে সে এই লাইনে দাঁড়িয়ে একটু আগে একটা অটোগ্রাফ নিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি একটা অটোগ্রাফ নিয়ে আবার লাইনের পেছনে দাঁড়িয়েছ?’ সে মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আরেকটা অটোগ্রাফের জন্য? সে আবার মাথা নাড়ল। আমার কী একটা সন্দেহ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই অটোগ্রাফ নিয়ে আবার তুমি লাইনের পেছনে দাঁড়াবে?’ সে আবার মাথা নাড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’ মেয়েটিকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। সে কোনো উত্তর দিল না। আমি বুঝতে পারলাম কারণটি তার জানা নেই। এটি মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি আগেও দেখেছি, আমরা যেসব কাজকর্ম করি, তার অনেক কিছুই কেন করি, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই। মেয়েটি কথা বলতে পছন্দ করে না, মাথা নেড়ে উত্তর দেয়; তাই তাকে আর বেশি প্রশ্ন করলাম না। তার ডায়রিতে একসঙ্গে অনেক অটোগ্রাফ দিয়ে দিলাম। সে তার পরও আবার লাইনের পেছনে দাঁড়িয়েছিল কি না, জানা নেই!
লেখকেরা যখন বইমেলায় যান, তখন তাঁরা কোনো একটা প্রকাশকের স্টলে বসেন। আমি কখনো সেটা করি না। স্টলের ঘুপচি ঘরে বসার থেকে বটতলার বিশাল খোলা জায়গায় বসতে আমার খুব ভালো লাগে। বসে বসে মানুষজন দেখা খুব মজার একটা ব্যাপার। প্রত্যেক মানুষ ভিন্ন, তাদের হাবভাব ভিন্ন, কথা বলার ভঙ্গি, চলাফেরা—সবকিছু ভিন্ন। দূর থেকে দেখতে খুব ভালো লাগে। সব সময় যে একা বসে থাকতে পারি, তা নয়। মাঝেমধ্যে আঁতেল-টাইপের কোনো একজন একেবারে গা ঘেঁষে বসে বড় বড় বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করে দেয়।
একবার সে রকমভাবে বসে একজন আঁতেলের কথা শুনছি। সামনে বেশ কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়ের জটলা। তাদের অটোগ্রাফ দিচ্ছি। আঁতেল কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে বসল, ‘বুঝলেন স্যার? আসলে বাংলাদেশ হওয়ার দরকার ছিল না। পাকিস্তানই ভালো ছিল।’
ব্যস্, আর যায় কোথায়! সামনে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা খেপে উঠল। চিৎকার-হইচই, ‘ব্যাটা, তোর কত বড় সাহস, তুই একুশের বইমেলায় বসে বলিস পাকিস্তান ভালো ছিল?’ কিন্তু বোঝার আগে দেখি, সবাই মিলে আঁতেলকে টেনে নামিয়েছে, তারপর দল বেঁধে, আক্ষরিক অর্থে ঘাড় ধরে তাকে বইমেলা থেকে বের করে দিয়ে এসেছে।
এ রকম অভিজ্ঞতা আরও আছে। বটতলায় বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছি, পাশে আমার স্ত্রী ইয়াসমীন। সামনে ছোট-বড় অনেক ছেলেমেয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। হঠাৎ করে শুনি, ইয়াসমীন তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠেছে, ‘এই যে, এই যে সাদা শার্ট...।’
সাদা শার্ট মানুষটা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। আমার স্ত্রী নেমে গিয়ে মানুষটাকে পাকড়াও করল। হুংকার দিয়ে বলল, ‘তোমার এত বড় সাহস? তুমি ভেবেছ কী? তুমি কি ভেবেছ আমি দেখিনি, তুমি কী করেছ?’
মানুষটা একটা মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ে চুমু খেয়েছে। বিব্রত মেয়েটি সরে যাওয়ার পর ইয়াসমীন তাকে ধরেছে। পাবলিক পারলে তখনই তাকে গণধোলাই দেয়। কোনোমতে উদ্ধার করে কয়েকজন তাকে ধরে নিয়ে পুলিশ-র‌্যাবের কাছে সোপর্দ করে দিয়ে এল। কয় দিন হাজতের ভাত খেয়ে সে নিশ্চয়ই ছাড়া পেয়ে আবার ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেছন থেকে অন্য কোনো মেয়ের ঘাড়ে ড্রাকুলার মতো দাঁত বসানোর জন্য। বজ্জাত কোথাকার!
বইমেলায় অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় আমি মাঝেমধ্যে বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে হালকা আলাপ করার চেষ্টা করি। সেটা মাঝেমধ্যে বুমেরাং হয়ে ফেরত আসে। অনেক উদাহরণ আছে। তার মধ্যে একটি এ রকম—কমবয়সী একটি মেয়ে বয়স্ক একজন মানুষের সঙ্গে অটোগ্রাফ নিতে এসেছে। অটোগ্রাফ দিতে দিতে আমি বললাম, ‘আব্বুর সঙ্গে বইমেলায় এসেছ, তাই না?’ মেয়েটা বলল, ‘আব্বু না। আমার হাজব্যান্ড।’ আমি জীবনে এ রকম অপ্রস্তুত হয়েছি বলে মনে হয় না। কান ধরে প্রতিজ্ঞা করেছি আর কখনো হালকা আলাপের চেষ্টা করব না।
অটোগ্রাফ শুধু যে প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক, প্রিয় শিল্পী বা খেলোয়াড়দের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তা নয়, এর মাঝে যে খানিকটা অর্থনৈতিক বিষয়ও থাকতে পারে, সেটাও আমি একবার আবিষ্কার করেছিলাম। আমার একজন সমকর্মীর বিয়েতে গিয়েছি, সেখানে অনেক মানুষ। তার মধ্যে ছোট একটা বাচ্চা ছুটে এসে একটা কাগজে আমার অটোগ্রাফ নিয়ে গেল। একটু পর সে আবার হাজির। এবার তার হাতে একটা বিজনেস কার্ড। সে বিজনেস কার্ডের পেছনে অটোগ্রাফ নিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর সে আবার হাজির হলো। এবার তার হাতে বেশ কয়েকটি বিজনেস কার্ড। আমাকে সবগুলোর পেছনে অটোগ্রাফ দিতে হলো। কিছুক্ষণ পর সে আবার হাজির আরও কয়েকটি বিজনেস কার্ড নিয়ে। এভাবে কয়েকবার হওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? তুমি কী করছ?’ সে গলা নামিয়ে চোখ টিপে বলল, ‘১০ টাকা করে বিক্রি করছি।’ এটুকু বাচ্চার এই ব্যবসা-বুদ্ধি দেখে আমি চমৎকৃত হলাম। বড় হলে সে নির্ঘাত বিল গেটস হবে।
বইমেলার ছোট দুটি ঘটনা বলে শেষ করি। ছোট একটি বাচ্চা বড় একটা বই নিয়ে আমার কাছে এসেছে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। আমার কী মনে হলো, ভাবলাম, একটু ঠাট্টা করি। বাচ্চাটাকে বললাম, ‘অটোগ্রাফ নিতে দুই টাকা লাগে। তোমার কাছে দুই টাকা আছে?’ ছোট বাচ্চাটা খানিকক্ষণ শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঠোঁট উল্টে বলল, ‘চাই না আমার অটোগ্রাফ।’ তারপর সে হেঁটে চলে গেল। আমি ছুটে গিয়ে ধরে এনে কোনোমতে তাকে শান্ত করে তার বইয়ে অটোগ্রাফ দিলাম।
এ রকম আরেকবার একজন মা তাঁর ফুটফুটে বাচ্চাকে নিয়ে আমার কাছে এসেছেন। বাচ্চার হাতে একটা বই। মা আমাকে অনুরোধ করলেন তাঁর বাচ্চার বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিতে। আমি অটোগ্রাফ দিয়ে বইটি বাচ্চার হাতে ফেরত দিয়েছি। বাচ্চাটা অটোগ্রাফ দেওয়া পৃষ্ঠাটি একনজর দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে বলল, ‘আমার এত সুন্দর বইটা নষ্ট কইরা দিছে।’
আমি যতটুকু অপ্রস্তুত, মা-বেচারী তার থেকেও বেশি অপ্রস্তুত। যারা লেখক, তাদের সবাইকে কম-বেশি কিছু অটোগ্রাফ দিতে হবে; কিন্তু একটু সাবধান থাকা ভালো। কিছু কিছু অটোগ্রাফ নিশ্চিতভাবেই বুমেরাং হয়ে ফেরত আসবে।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার: 

No comments:

Post a Comment