4 November 2011

 মানবাধিকার

আর নীরব থাকা উচিত নয়

আইরিন খান
বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে একটি শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিশ্রুতি, যেখানে থাকবে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য এবং সবার জন্য ন্যায়বিচার। কিন্তু আমরা সবাই জানি, বাস্তবতা খুবই অন্য রকম।
তবু আমি মানতে রাজি নই যে মানবাধিকারের অঙ্গীকার একটি শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি। আমি স্বীকার করি, আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জের অন্ত নেই। অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন কার্যকর ও জবাবদিহিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এমন একটি বিচারব্যবস্থা দরকার, যা ভয়ভীতি ও আনুকূল্যের ঊর্ধ্বে থেকে বিচার প্রদান করে। তা ছাড়া আইন হবে সব নাগরিকের জন্য সমান এবং সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এ চিন্তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আকাশকুসুম মনে হতে পারে; তবে আমি বিশ্বাস করি, আমাদের জনগণের মধ্যে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এবং পরিবর্তন আনার সাহস, শক্তি, চাহিদা ও দূরদৃষ্টি—সবই আছে।
স্বাধীনতা মানে শুধু ভোটাধিকার প্রয়োগ করা নয়, বরং এর চেয়ে বেশি কিছু। স্বাধীনতা মানে নিঃশঙ্কচিত্তে মর্যাদার সঙ্গে বৈষম্যমুক্ত জীবন যাপন করা।
নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে যখন ‘ক্রসফায়ার’ নামের শব্দের আড়ালে নাকচ করা হয়; সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে যখন হয়রানি কিংবা নির্যাতন করা হয়; যখন মানুষকে অপহরণ করে গুম করা হয়; রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ পুলিশ যখন আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কোনো কর্মতৎপরতা দেখায় না; ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালতের কর্মকর্তাদের ঘুষ দাবির কারণে যখন দরিদ্র জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার পায় না; রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করতে পারে না বলে মানুষ যখন উপায় না পেয়ে বিচারের ভার নিজের হাতে তুলে নেয়— তখন আমাদের জীবন মুক্ত নয়, বরং ভীতি-শঙ্কাময়।
সরকারের উচিত, র‌্যাব বাতিল করে পুলিশের সংস্কার করা, পুলিশকে শক্তিশালী করা। পুলিশের সংস্কারের জন্য প্রয়োজন একটি নতুন আইন, নতুন বিধিবিধান, উন্নত প্রশিক্ষণ ও উন্নত চাকরির পরিবেশ এবং একটি স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থা। আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যদের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া উচিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে রাজনৈতিক নেতাদের মানসিকতায়। রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে পুলিশ বাহিনীকে অযাচিতভাবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ ও স্বজনপ্রীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচগুলোর যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন। পুলিশ বাহিনীর পেশাদারি মানসিকতা বজায় রাখা উচিত। পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া উচিত। লোকবল নির্ধারণ, নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলির বিষয়গুলো সম্পন্ন হওয়া উচিত মেধার ভিত্তিতে।
আইনসম্মতভাবে অভিযোগ গঠন ও বিচার করে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে অপরাধ দমন করতে হলে জননিরাপত্তা বিভাগ ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে একযোগে। রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্বাহী বিভাগের চাপ থেকে বের করে আনতে হবে আদালতকে। অপরাধের শিকার ব্যক্তি ও সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, সাক্ষ্যপ্রমাণে কারসাজি এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালতের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ঘুষ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর নজরদারি ও অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে ঘোষণা করা হয়েছে, জন্মগভাবে প্রতিটি মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমান। আমাদের সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু শুধু সরকারি ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করে। বিবাহ, তালাক, সন্তানদের হেফাজত, ভরণপোষণ ইত্যাদি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রিত হয় প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মীয় বিধিবিধানের আওতায়, যেখানে নারীরা ভীষণভাবে বৈষম্যের শিকার।
নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা কেবল আর্থসামাজিক উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং এটি এমন একটি অসাধু ও অসম পরিবেশের সৃষ্টি করে, যেখানে লিঙ্গ-শোষণ শাখা-প্রশাখা বিস্তারের সুযোগ পায়।
জাতিসংঘের এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৪৭ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার। যৌতুক দিতে না পারায় এখন নববিবাহিত অনেক নারীকে পুড়িয়ে মারা হয়। স্ত্রীদের নির্দয়ভাবে পেটানো হয়। বখাটেদের উৎপাতে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা আত্মহত্যায় বাধ্য হয়। এসিড ছোড়ার কারণে যুবতী নারীদের অঙ্গহানি পর্যন্ত হয়ে থাকে। নারীকর্মীরা তাঁদের কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে পর্যুদস্ত হয়ে থাকেন। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনাও নারীরা প্রকাশ করেন না ভয়, লজ্জা ও কলঙ্কের আশঙ্কায়। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সালিশের নামে অপরাধীদের কিছু না বলে অপরাধের শিকার নারীদেরই অমানুষিক শাস্তি দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার আইন রয়েছে। ফতোয়া নিষিদ্ধ করে এবং নারীদের পোশাক, তাদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধানিষেধকে নিষিদ্ধ করে আদালত রায় দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। পরিবর্তন ঘটাতে হলে এসব আইন-কানুন ও আদালতের আদেশের আরও কঠোর প্রয়োগ ঘটানো দরকার; নারী সংগঠনগুলোর প্রতি আরও সমর্থন এবং নির্যাতনের শিকার নারীদের আরও বেশি সহযোগিতার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আর নীরব থাকা উচিত নয়। নারীদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার অজুহাত হিসেবে রীতি-প্রথা, সংস্কৃতি বা ধর্মকে ব্যবহার করা চলবে না। প্রতিটি মসজিদ, মন্দির ও গির্জায় বিবেকবান মানুষের উচিত সোচ্চার হওয়া, যেন ধর্মীয় নেতারাসহ সমবেত সবাই নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, নিন্দা করেন।
আমাদের আইনি ব্যবস্থায় বিদ্যমান শঠতার অবসান অত্যাবশ্যকীয়। ব্যক্তিগত আইন যখন নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক, তখন ফৌজদারি আইন কীভাবে নারীদের সুরক্ষা দিতে পারে? একটি অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে অপ্রচলিত ও সেকেলে ধর্মীয় অনুশাসনের জায়গা থাকতে পারে না, বরং একটি ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড চালু করা উচিত, যার অধীনে ধর্ম-বর্ণ-মত-গোত্র-লিঙ্গনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সম-অধিকার ভোগ করবে। এ বছরের শুরুতে সরকার কর্তৃক গৃহীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি পরিবার নীতিমালা তৈরির পথ সুগম করা।
বাংলাদেশ টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে বহুদূর এগিয়েছে। তবে সমাজের সর্বস্তর এ প্রবৃদ্ধি থেকে সমান ও নিরপেক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে না। আমাদের সাড়ে ৩১ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং প্রায় এক-পঞ্চমাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। মানবাধিকারকে উপেক্ষা করার একটি প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে এই দারিদ্র্য।
খাদ্য, পানীয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য আমাদের মৌলিক মানবাধিকার, যেগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্রের মানবাধিকারের দায়িত্বগুলো বাজারের কাছে সমর্পণ করে দেওয়া উচিত নয়, বরং রাষ্ট্রের উচিত জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং জনগণের পারিশ্রমিকের একটি ন্যূনতম মান বজায় রাখা। দারিদ্র্যে নিমজ্জিত জনগোষ্ঠীকে শুধুমাত্র দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসেবে দেখা ভুল। তাদের অধিকার আছে, তারা অধিকারধারী। এমন মানুষজন একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অন্তর্ভুক্ত। যখন মানুষ নিজেদের অধিকার ভোগকারী হিসেবে বিবেচনা করে, তখন তারা মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। তারা অনুভব করে নিজেদের সংগঠিত করার শক্তি তাদের রয়েছে; যারা তাদের নামে দেশ শাসন করে, তাদের কাছে তখন তারা নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারে। জনগণের এসব পদক্ষেপের দরুন কর্তৃপক্ষ আরও বেশি সহানুভূতিশীল ও জবাবদিহিমূলক আচরণে বাধ্য হয়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—বেদে, ঋষি, ভাগচাষি কিংবা বর্গাচাষিরা নিজেদের সংগঠিত করছে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কাছ থেকে জবাবদিহি দাবি করার জন্য। এ ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা মানবাধিকারের দৃশ্যপটটি পুনরঙ্কন করছে। তা ছাড়া এসব পদক্ষেপ অন্য গোষ্ঠীগুলোকেও মানবাধিকারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে।
মানবাধিকার মানুষকে অংশগ্রহণ-অধিকারে সচেতন করে—স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, তথ্য ও সভা-সমাবেশের অধিকার। অধিকাংশ সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর সাংঘর্ষিক, অত্যাচারমূলক মুখোমুখি রাজনীতি অপছন্দ করে। গঠনমূলক ও কল্যাণমুখী একটি রাজনীতির প্রত্যাশা করে তারা।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। প্রথম আলোর তেরো বছরের ইতিহাস তারই দলিল। তবে কিছু সূক্ষ্ম চাপ গণমাধ্যমের ওপর রয়েছে। ফৌজদারি মানহানি মামলার ঘটনাগুলো সম্পাদকদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই কালো আইন বাতিল করা উচিত। মানুষের জানার অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা বাড়াতে আদালত অবমাননা আইনেরও ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। যারা সাংবাদিকদের আক্রমণ ও হুমকি প্রদান করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতার ব্যাপারে সরকারকে আরও অঙ্গীকার দেখাতে হবে।
রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব মানবাধিকার নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বচ্ছতা আদায়ের ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনের আরও বেশি সাহসী ভূমিকা রাখা উচিত। তাদের উচিত একটি জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় নাগরিকদের সাহায্য করা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে তার নিজস্ব কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য আরও বেশি ক্ষমতা ও সম্পদ প্রদান করা উচিত। দুর্নীতির ব্যাপকতা অনুধাবন করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্বল করার পরিবর্তে শক্তিশালী করা উচিত যথাযথ আইনি সংশোধনের মাধ্যমে।
কিন্তু, মানবাধিকার সংস্কারের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে আমি দৃঢ় পদক্ষেপ বা স্পৃহা দেখি না। এটি নাগরিকদের মধ্য থেকে আসতে হবে। আমাদের জনগণের প্রাণপ্রাচুর্য আছে। আমাদের সুশীল সমাজ গতিশীল। আমাদের গণমাধ্যম সাহসী। চূড়ান্ত অর্থে, জনগণের শক্তির মাধ্যমেই বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হবে।
আইরিন খান: মানবাধিকার কর্মী। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সাবেক মহাসচিব।

Courtesy:

No comments:

Post a Comment

বালিয়া মসজিদ জ্বীনের মসজিদ  স্থানীয়ভাবে এবং লোকমুখে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘বালিয়া মসজিদ’। জমিদার মেহের বকস চৌধুরী ...