4 November 2011

Social Business


তরুণরাই এগিয়ে থাকবে
মুহাম্মদ ইউনূস
আমার বিশ্বাস, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে একটা সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ব সৃষ্টির সূচনা হবে। অতীতের ধ্যান-ধারণা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে। এখন থেকে ৩০ বছর ঘুমিয়ে থাকার পর কেউ যদি জেগে ওঠে, সে তার পরিচিত পৃথিবীকে খুঁজে পাবে না।
এই নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করবে তরুণেরা, ১৫ থেকে ৩০ বছরের ‘কাঁচা বয়সী’ বালক-বালিকা ও তরুণ-তরুণীরা। আমাদের মতো পুরোনোদের প্রভাববলয় থেকে যত তাড়াতাড়ি তারা মুক্ত হতে পারবে, তারা তত তাড়াতাড়ি এই নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করবে। আমাদের চিন্তা-ধারণার সঙ্গে তাদের চিন্তা-ধারণা মিলবে না। তারা আমাদের মতো বৈষয়িক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হবে না। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সৃজনশীল হবে। তারা দ্রুত সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবে এবং তা কাজে লাগাবে। যে সমস্যা সম্পর্কে বুঝে উঠতে আমাদের এক দশক বা তারও বেশি সময় লেগেছে, তারা সেটা বুঝে নেবে কয়েক মাসে এবং এগিয়ে যাবে সমাধানের পথে। তারা তাদের নিজস্ব সামাজিক কর্মযজ্ঞের পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে নেবে। আমরা যেটা ‘অসম্ভব’ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছি, তারা সেটার ঘাড় ধরে সম্ভবে পরিণত করার মহোৎসবে মেতে উঠবে। সম্ভব এবং অসম্ভবের দূরত্ব তারা হেসে-খেলে এমনভাবে কমিয়ে ফেলবে যে অসম্ভবের তালিকা দ্রুত শূন্যের দিকে এগোতে থাকবে।
তরুণদের এই শক্তি কোথা থেকে আসছে? এটা তাদের কোনো নতুন শক্তি নয়। এটা আমাদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু আমরা তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারিনি। আমাদের হাতে সেই সুযোগ ছিল না। মানুষের সৃজনশীলতা সীমাহীন। সেই সীমাহীন সৃজনশীলতার একটা অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ব্যবহার করেই আমরা আমাদের জগৎ সৃষ্টি করেছি। আমাদের মধ্যে আলাদিনের চেরাগ ছিল। আমরা এটা দিয়ে শুধু সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়েছি। চেরাগের আসল খবর আমাদের কাছে অজানা রয়ে গেছে। আমরা সমস্যার পাহাড় গড়েছি, সমাধান খুঁজে পাইনি। অথচ মানুষের সৃজনশীলতার সামনে পৃথিবীর কোনো সমস্যাই টিকে থাকতে পারার কথা নয়। কিন্তু আমরা সমস্যার ভয়ে কেবলই কুঁকড়ে গিয়েছি। সমস্যার কথা বলে বলে একে অন্যকে আরও ভয় লাগিয়ে দিয়েছি।
তথ্যপ্রযুক্তি এসে সব পাল্টে দিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির, তার সঙ্গে ন্যানো প্রযুক্তির, এখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু। এসব প্রযুক্তি এখনো হামাগুড়ি পর্যায়ে আছে। এটা যখন হাঁটতে শিখবে, দৌড়াতে শিখবে, তখন অন্য বিশ্ব সৃষ্টি হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির সামগ্রিক বিকাশের সামনে এখন আছে একটা বড় বাধা। এই প্রযুক্তি মুনাফার জগতে বন্দী। তাকে এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে তার সামনে মানবমঙ্গলের পথটি খুলে দিতে পারলে মানুষের মুক্তি আসবে দ্রুতগতিতে। এই জন্য মুনাফাভিত্তিক ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসার নতুন পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সামাজিক ব্যবসা তথ্যপ্রযুক্তিকে মুনাফার বন্ধন থেকে বের করে আনবে।
এ পর্যন্ত মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে প্রকাশ করার সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যর্থতা। আলাদিনের প্রদীপের সন্ধান পাওয়া দূরে থাকুক—আমরা এখনো কোটি কোটি মানুষকে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর ক্ষমতা সম্বন্ধেও অবহিত করতে পারিনি। ধনী দেশ, গরিব দেশ, সব দেশের কোটি কোটি মানুষকে ‘বেকার’ থাকতে বাধ্য করে রেখেছি। যে মানুষ পৃথিবী পাল্টে ফেলার ক্ষমতা রাখে, তাকে একটি পশুর মধ্যে যে ক্ষমতা আছে, যে ক্ষমতায় সে নিজের জীবন নিজে চালাতে পারে, সে ক্ষমতা থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত করে রেখেছি।
মানুষের নতুন সভ্যতা গড়ার সময় অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছিল। এখন সেই সভ্যতা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আমরা সৌভাগ্যবান যে সেই সভ্যতা সৃষ্টির কাজে আমরা কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখার সুযোগ পাব। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ভূমিকা রাখার জন্য আমরা কী প্রস্তুতি নিচ্ছি?
তরুণ-তরুণীদের হাতেই এই নতুন পৃথিবী রচিত হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে গরিব দেশের বালক-বালিকা ও তরুণ-তরুণীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। কারণটা সোজা। ধনী দেশ ও গরিব দেশ, সবার হাতেই একই প্রযুক্তি থাকবে। কিন্তু গরিব দেশের তরুণ-তরুণীর সামনে তা দ্রুত প্রয়োগ করার ‘ঠেকাটা’ হবে বেশি। তাদের সামনে থাকবে সমস্যার মহাসমুদ্র। এটা পাড়ি দেওয়ার জন্য তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে প্রথমে। ধনী দেশেও এসব সমস্যার মহাসমুদ্র একসময় ছিল। তারা এটা অতিক্রম করেছে পুরোনো চিন্তা ও পুরোনো প্রযুক্তি দিয়ে। তাদের সমাধানে অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে গেছে, তাদের কোনো কোনো সমাধান নতুন সমস্যারও সৃষ্টি করেছে। গরিব দেশের যখন যাত্রা শুরু হলো তখন প্রযুক্তি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন সমাধান আসবে অনেক সুসংহত আকারে, নতুন সমস্যার সৃষ্টি না করে।
নতুন বিশ্বরচনায় যে তরুণেরা নেতৃত্ব দেবে, তাদের এখন পৃথিবীতে আসা শুরু হয়েছে। আপনার আমার পরিবারে এবং ধনী-দরিদ্র সব পরিবারে তাদের জন্ম হচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা এই নতুন বিশ্বরচনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সমস্যা সমাধানের কাজে, সৃজনশীলতা প্রকাশে বিশ্বে স্থান করে নিতে পেরেছে। আগামী প্রজন্ম এই অগ্রণী ভূমিকাকে শুধু ধরে রাখতে পারবে তা-ই নয়, বরং সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে। আমাদের সচেতন হতে হবে, এই নতুন প্রজন্মকে আমরা কীভাবে গড়ে তুলব, সেটা নিয়ে। তাদের জন্য যোগ্য পরিবেশ গড়ে তোলার সামগ্রিক দায়িত্ব আমাদের হাতে। তাদের বাধাহীনভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে। ৩০ বছরের নিচে সবার জন্য নিখরচায় ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাকে যে রকম নিখরচায় সব শিশুর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, ব্রডব্যান্ড কানেকটিভিটিকেও তার সঙ্গে একই পর্যায়ে রাখতে হবে। একে প্রত্যেকের আত্ম-আবিষ্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এবং নিজের ও দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার আবশ্যিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই সংঘাতবিহীন, ভবিষ্যৎমুখী এবং সুস্থ রাজনৈতিক পরিমণ্ডল তৈরি করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমস্যা নিয়ে কান্নাকাটি করে সময় কাটালে সমস্যার সমাধান আসবে না। সমস্যার অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসার জন্য যে মহাসড়ক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, সেই মহাসড়কে আমাদের তরুণদের নির্বিঘ্নে উঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপদে তাদের কাজে মনোনিবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তা যদি পারি, তাহলে তারা শুধু বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান করবে না, তারা আরেক নতুন পৃথিবী সৃষ্টির পথে নেতৃত্ব দেবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক এমডি, নোবেল বিজয়ী।

Courtesy:

No comments:

Post a Comment

বালিয়া মসজিদ জ্বীনের মসজিদ  স্থানীয়ভাবে এবং লোকমুখে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘বালিয়া মসজিদ’। জমিদার মেহের বকস চৌধুরী ...