4 November 2011

Global Warming


জলবায়ু পরিবর্তন

উষ্ণ জলবায়ু, মানুষের সংগ্রাম
আইনুন নিশাত
জলবায়ু পরিবর্তনের আশঙ্কা যে একেবারে বাস্তব, তা এখন সব রাষ্ট্র মেনে নিয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেনসহ বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। কারণ, শিল্পায়ন হচ্ছে, মানুষ বাড়ছে আর তাই বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা, বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ, ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন ইত্যাদি। সমগ্র বিশ্ব উদ্বিগ্ন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে পদক্ষেপগুলোকে সঠিক করার জন্য। এই প্রেক্ষাপটে এখন থেকে ৫০ বছর পরে বাংলাদেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে, সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রতিপাদ্যের বিষয় হচ্ছে ‘স্বপ্নের স্বদেশ’। আমি বাংলাদেশের জন্য যে স্বপ্ন দেখি, তাহলো দেশটা এ রকম হবে—আমাদের আশা, এই দেশের প্রতিটি মানুষের সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়েছে, ক্ষুধার তাড়নায় কেউ পীড়িত নেই, সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থান আছে, শিক্ষাব্যবস্থা সুচারুরূপে গড়ে উঠেছে, সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই তার প্রাপ্য অংশটুকু বুঝে নিতে পারছে এবং দেশে আর অতি দরিদ্র কেউ নেই, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত ও নিরাপদ হয়েছে, পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিতে পারছি, টলটলে পানিতে জলজ উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ জলাধারগুলোকে যেভাবে দেখতে চাই, ঠিক তা-ই আছে; নদীগুলো নৌবিহারের জন্য উপযুক্ত; এ রকম আরও অনেক কিছু। কিন্তু আমরা অত্যন্ত আতঙ্কে আছি, এগুলোর অর্জন নাও হতে পারে, বরং অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে আমাদের অবস্থান হবে। কারণটি হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়া এবং এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হওয়া ও আবহাওয়ায় বিপর্যয় আসা।
বিশ্বের গড় তাপমাত্রা তিন থেকে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়তে পারে, এতে খাদ্য-ঘাটতি দেখা দেবে, এই ভয় পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের। জীববৈচিত্র্য খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না, বহু প্রজাতি হারিয়ে যাবে এবং জীববৈচিত্র্যের যে ভারসাম্য আছে, তা কোনোমতেই রক্ষিত হবে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নয়নের লক্ষ্যে যে অবকাঠামো গড়ে তুলবে, তা বিভিন্ন কারণে হুমকির সম্মুখীন হবে, রোগবালাই বাড়বে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ব্যবস্থাপনার দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে, প্রতিটি আবাসস্থল, প্রতিটি নগর, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের নগরগুলো এমন সব হুমকির সম্মুখীন হবে যে মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হবে। তাহলে ৫০ বছর পরে আমাদের স্বদেশ কি স্বপ্নের থাকবে, নাকি দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হবে—এটাই আজকের ভাবার বিষয়।
১৯৯২ সালে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়ন করে, বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবেই তাতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করে, যে কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, অর্থাৎ যে গ্যাসগুলো এর জন্য দায়ী, যার প্রধান হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড, এগুলোর উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু লক্ষ্যটি অর্জিত হয়নি। যদিও এই নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরবর্তীকালে কিয়োটো চুক্তি প্রণীত হয় ১৯৯৭ সালে। কার্যকর হয় ২০০৫ সালে। পৃথিবীর ২৭টি উন্নত দেশ তাদের দায় স্বীকার করে নিয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে তারা কিছুটা কাজও করছে। তবে অন্যতম প্রধান দূষণকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি মানতে অস্বীকার করেছে। ঘুরিয়ে বললে বলতে হবে, যেসব দেশ গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর ক্ষেত্রে কাজ করছে, তারা বিশ্বের মাত্র ৩০ শতাংশ গ্যাস উৎপাদনকারী। বাকি ৭০ শতাংশের কাছাকাছি গ্যাস উৎপাদনকারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনতে পারলে জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকবে। কিয়োটো চুক্তি ২০১২ সাল পর্যন্ত কাজ করবে। ২০১২ সালের পরে কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই চুক্তি পালনের দায় থেকে তিনটি দেশ বেরিয়ে যেতে চাইছে। তারা বলছে, বিশ্বের প্রধান দূষণকারী দেশ (জাপান, রাশিয়া ও কানাডা) অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন—এই তিনটি দেশসহ যেসব দেশের মাথাপিছু উৎপাদনের পরিমাণ অনেক (যেমন আরব দেশগুলো) এবং যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট উন্নত (যেমন সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া), সেগুলো যদি গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন কমানোর ক্ষেত্রে উদ্যোগী না হয়, তাহলে কেবল ৩৭টি উন্নয়নশীল দেশের প্রয়াস ফলপ্রসূ হবে না। ওই তিনটি দেশ বেরিয়ে গেলে ৮৩ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনকারী দেশসমূহের কোনো দায়দায়িত্ব থাকল না। তাহলে ১৭ শতাংশের দায় স্বীকারকারী দেশগুলো এই বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? মোটেই না।
এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা চালায় যে প্রতিষ্ঠানটি, তার নাম আইপিসিসি। তাদের চতুর্থ প্রতিবেদন বের হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেখানে তারা নিশ্চিত করে বলেছে যে গ্রিনহাউস গ্যাস বাড়ার কারণ হলো মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, এটা প্রাকৃতিক নয়। মানুষের কর্মকাণ্ডকে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারি, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো কি কখনো দূর করা সম্ভব? এই কাজকে আমরা বলে থাকি ‘মিটিগেশন’ বা ‘প্রশমন’। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছিল যে বর্তমান ধারা চলতে থাকলে বিশ্বের আবহাওয়ায় কোনো সময়ই স্থায়িত্ব আসবে না। অর্থাৎ আবহাওয়া ক্রমান্বয়ে অশান্ত হতে থাকবে।
১৯৯২ সালে আবার ফিরে গেলে দেখতে পাই, বিশ্ব মেনে নিয়েছিল যে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে উন্নত বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের কারণে। দায়িত্ব তাই তাদের এবং তারা এর কারণ দূর করার দায় স্বীকার করে নিয়েছিল। অনুন্নত দেশগুলো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য যে কাজটি করতে হবে, তার নাম দেওয়া হয়েছিল অ্যাডাপটেশন বা ‘অভিযোজন’। এ কাজে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, তা জোগানোর কাজটি উন্নত দেশগুলো করবে।
২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রশাসন ও অভিযোজন কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য একটি সিদ্ধান্ত হয়। এটি বালি (ইন্দোনেশিয়ার শহর) চুক্তি নামে পরিচিত। পাঁচটি কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হয়। প্রথমত, সমগ্র বিশ্ব কতগুলো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। দ্বিতীয়ত, প্রশমনের জন্য অধিকতর প্রয়াসী হওয়ার পন্থা বের করা। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে কীভাবে অভিযোজনের ক্ষেত্রে অধিকতর প্রয়াসী হওয়া যাবে। চতুর্থত, এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন কীভাবে হবে। এবং পঞ্চমত, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও দক্ষতা অর্জনের কাজটির কর্মপন্থা নির্ধারণ।
আশা করা হয়েছিল, ২০০৯ সালের মধ্যে এই পাঁচটি বিষয়ে পৃথিবী আইনসিদ্ধ চুক্তিতে পৌঁছাবে। বহু আলোচনা হয়েছে কিন্তু সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০১০ সালে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে আরও আলোচনা হবে। আমি যেহেতু এই আলোচনাটা নিয়মিতভাবে অনুসরণ করছি, আমার ভয় হচ্ছে, ডারবানেও খুব একটা বড় কিছু অগ্রগতি হবে না। আইপিসিসির পঞ্চম রিপোর্ট বের হবে ২০১৫ সালে, তখন হয়তো সমগ্র বিশ্ব নড়েচড়ে বসবে। কিন্তু ইতিমধ্যে যা ক্ষতি হওয়ার তা হবে।
কেন আমি ভয় পাচ্ছি যে বাংলাদেশ একটি দুঃস্বপ্নের দেশে পরিণত হবে? তার আগে আমরা দেখে নিই, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে সেগুলো কী কী? প্রধানত, বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হবে। আমাদের বর্ষানির্ভর যে কৃষিব্যবস্থা আছে, তা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। উপকূলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে, এখন থেকে ১০০ বছর পরে বর্তমানের উপকূল তটরেখা যেটা বরগুনা, পটুয়াখালীর দক্ষিণে কিংবা হাতিয়া-সন্দ্বীপের নিচে, সেটি ওপরে উঠে চাঁদপুর বরাবর চলে আসতে পারে। নারায়ণগঞ্জের পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে, চাঁদপুর তো সমুদ্র উপকূলে পরিণত হবে। এর ফলে উপকূল অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। বৃষ্টির পরিমাণ ও সময় অনিশ্চিত হওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদনও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আর একটি কারণ হলো তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। যেভাবে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে, এখন থেকে ১০০ বছরে এটি চার-পাঁচ ডিগ্রি বেড়ে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এবং দুই ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা বাড়লেই খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন নতুন প্রজাতির ফসল উদ্ভাবনের জন্য, যা লবণসহিষ্ণু, খরা সহ্য করতে পারে, বন্যা সহ্য করতে পারে এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এ ধরনের ধান কিংবা বিভিন্ন ফসলের বীজের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং এর ফলে যে মাত্রার লবণাক্ততা, খরা ও বন্যার প্রকোপ বাড়বে, সেই মাত্রা সহনীয় ফসলের বীজ আমরা এখনো হাতে পাইনি। ভবিষ্যতে যে পাওয়া যাবে না, সে কথা আমরা বলছি না; কেবল ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথাটি তুলে ধরছি।
উপকূলে লবণাক্ততার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। সিডর ও আইলার মতো জলোচ্ছ্বাস যদি তিন-চার বছর পর পর হতে থাকে, তাহলে উপকূলে মানুষের বসবাস অনিশ্চিত হয়ে যাবে, বাধ্য হবে তারা দেশান্তরী হতে। ডেঙ্গুজ্বর আগে ছিল না, এটা এ দেশে এসেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আফ্রিকায় বেড়েছে, আমাদের দেশেও বাড়বে বলে ভয় হচ্ছে।
এসব প্রক্রিয়া মোকাবিলা করার জন্য আমাদের বন্যা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, সেচব্যবস্থা, উপকূলীয় বাঁধব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নদীভাঙন বাড়বে, এর জন্য নদী শাসন প্রয়োজন। আমাদের ভয় হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রয়োজন অভিযোজনের কাজ সম্পন্ন করতে।
বাংলাদেশ এর মধ্যে মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় ১ শতাংশ মাত্র। কাজেই অভিযোজনের জন্য অর্থ জোগাড় করার কাজটি যদি এখনই জোরেশোরে শুরু না করা যায়, তাহলে কিন্তু যেসব আশঙ্কার কথা বলছি, সেগুলো থেকেই যাবে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে যে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে একটু ফিরে যেতে চাই। এই আলোচনার অগ্রগতির রাস্তায় অনেক অসুবিধা আছে। প্রতিটি দেশ তাদের তাৎক্ষণিক লাভের দিকে নজর দিতে গিয়ে এমন সব প্রস্তাব করে, তাতে অবাক হতে হয়। গোটা বিশ্বের বারোটা বাজছে, সেটা তাদের খেয়াল থাকে না। একটি বিষয়ে প্রচণ্ড বাধা আসছে অভিযোজনের অর্থায়ন নিয়ে এবং সেটি আসছে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর কাছ থেকে। এসব দেশের প্রতিনিধিরা বলছেন, প্রশমনের কাজ হাতে নিলে নবায়নযোগ্য শক্তি তথা সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুতের উৎপাদন বাড়বে এবং পেট্রোলজাত দ্রব্যের চাহিদা বা ব্যবহার কমে যাবে। এতে এসব দ্রব্যের বিক্রি কমে যাবে এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো দরিদ্র হয়ে যাবে। তারা বিশ্বের কাছে দাবি করছে, প্রশমনের কাজ হাতে নিলে তাদের অভিযোজনের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বলছে, অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন করবে। বলাটা সহজ কাজ, কিন্তু অর্থায়নের কাজ বেশ জটিল। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো যদি টাকা পেতে চায়, তাহলে তাদের অনেক শর্ত পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা অর্থায়ন করবে, যদি তারা দেখতে পায় যে অর্থটা সঠিক কাজে লাগছে, সঠিক জায়গায় ব্যবহূত হচ্ছে এবং দেশের সবচেয়ে অবহেলিত লোকজনের উপকারে লাগছে। এর জন্য প্রয়োজন অর্থ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও অংশীদারি।
আমি দেখতে পাচ্ছি, ২০২০ সাল থেকে পৃথিবী ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ বিভিন্ন দেশকে দেবে। কিন্তু এই অর্থ পাওয়ার জন্য আমাদের যে ক্যাপাসিটি বা দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন, সেটির ব্যাপারে আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের ওপর এত বেশি নির্ভরশীল যে আজও আমাদের দক্ষতার ওপর উন্নত বিশ্বের কোনো আস্থা জন্মায়নি। একইভাবে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। নতুন প্রযুক্তি আসে বহুলাংশে বেসরকারি খাতে, তারা নতুন প্রযুক্তি আনে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে। বিশ্ব বলছে, অর্থায়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহারে বেসরকারি খাতকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের দেশে এখনো সরকারি মহলের সঙ্গে বেসরকারি মহলের দূরত্ব এত বেশি যে, বেসরকারি খাতকে কাজে লাগিয়ে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অভিযোজন ও প্রশমনের কাজ করা হবে, সেই মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি।
তবে আমি আমার লেখাটি শেষ করছি কিছু আশার কথা বলে, বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এটাকে আমাদের মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করেছে এবং গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ এটিকে ব্যবহার করে প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং প্রতিটি সংস্থার কাজ করার কথা। আমার দুঃখ হচ্ছে, এই দলিলটির ব্যবহার এখনো বহুলাংশে সীমিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নেতারা অত্যন্ত অগ্রসর ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু দেশের ভেতর জরুরিভাবে তাদের নজর কামনা করছি।
প্রতিটি মন্ত্রণালয় যদি তাদের কর্মকাণ্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না করে এবং ওতপ্রোতভাবে যদি জড়িত না করে, তাহলে ৫০ বছর পরে হয়তো দেখব যে আমরা স্বপ্নের দেশের রাস্তায় ঠিকই অগ্রসর হতে চেষ্টা করেছি কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন সব বাধা এসেছে যে দেশবাসীর কাছে এবং বিশ্বের কাছে দেশটি দুঃস্বপ্নের দেশ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
অধ্যাপক আইনুন নিশাত: পরিবেশবিদ। উপাচার্য, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।


Courtesy:

No comments:

Post a Comment

বালিয়া মসজিদ জ্বীনের মসজিদ  স্থানীয়ভাবে এবং লোকমুখে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘বালিয়া মসজিদ’। জমিদার মেহের বকস চৌধুরী ...