23 April 2016

মাহীসন্তোষ

মাহীসন্তোষ
ধামুইরহাট, নওগাঁ
মাহীসন্তোষ মসজিদ নওঁগা জেলার ধামইর হাট থানা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিমি উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ২.২৫ মি পুরু দেওয়াল বিশিষ্ট আয়তাকার (বাইরে থেকে পরিমাপ ২৪ মি × ১৬.২০ মি) মসজিদটির চারকোণে চারটি অর্ধ অষ্টভুজাকার পার্শ্ববুরুজ ছিল। এগুলি ইট এবং পাথর দিয়ে নির্মিত। অভ্যন্তরভাগে ইট দিয়ে নির্মিত মসজিদটির ভেতর এবং বাইরের দেওয়ালের সম্মুখভাগ পাথরের ফলক দ্বারা আবৃত। মসজিদে প্রবেশের জন্য সম্মুখভাগে পাঁচটি প্রবেশপথ ছিল। খুব সম্ভবত কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি পাশের প্রবেশ পথগুলি অপেক্ষা বৃহদাকারের ছিল। উত্তর ও দক্ষিণের প্রতিপার্শ্বে তিনটি করে প্রবেশ পথ ছিল। প্রতি সারিতে চারটি করে দুই সারি প্রস্তর স্তম্ভের সাহায্যে মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ (১৯.৫০ মি × ১১.৭০ মি) বিভক্ত করা হয়েছিল। ঘনক (cube) আকৃতির পাথরের ভিত্তির উপর প্রতিটি স্তম্ভ ছিল দন্ডায়মান। বর্গাকার প্রতিটি স্তম্ভের দন্ড (Shaft) তিনটি অংশে বিভক্ত। সর্বনিম্নের অংশের পরিমাপ ০.৪০ মি এবং এর গায়ে ছিল ত্রিকোণাকার নকশা। মাঝের অংশের পরিমাপ ১.৫৫ মি। এখানে শিকল এবং ঘণ্টার নকশা দেখা যায়। সবচেয়ে উপরের বহুভুজ (১৬ বাহু বিশিষ্ট) আকৃতির অংশটির পরিমাপ ০.৯৬ মি। এই অংশে শিকল ও ঘণ্টার নকশা এবং অর্ধ বৃত্তাকার ঝুলন্ত মুক্তার নকশা রয়েছে।
মসজিদের কেন্দ্রীয় ‘নেভ’ পাশের অংশ অপেক্ষা বড় এবং তিনটি আয়তাকার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। এগুলির ছাদ সম্ভবত বাংলা চৌচালা রীতির খিলান ছাদে (Vault) আচ্ছাদিত ছিল। আর এর দুপাশের অংশ দুটি সম্ভবত আচ্ছাদিত ছিল সর্বমোট ১২টি অর্ধগোলাকার গম্বুজে। আচ্ছাদনের এই ব্যবস্থা বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এর (১৪৫৯ খ্রি) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
সম্মুখভাগের প্রবেশ পথের সমান্তরালে কিবলা দেওয়ালে রয়েছে পাঁচটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পাশেরগুলি অপেক্ষা সামান্য বড়। মিহরাবটি বর্তমানে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মূলত এই মিহরাবটি একটি পাথরখন্ড দিয়ে নির্মিত এবং সুন্দর অলংকরণে সজ্জিত। শিকল ও ঘণ্টা, পদ্ম এবং তালপত্র নকশা (Palmette) প্রধান মোটিফ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। উত্তর দিকের শেষ মিহরাবটির অভ্যন্তরে সুন্দরভাবে খোদাইকরা নকশা এখনও দৃশ্যমান। এটি দেখে মনে হয় পাথরের তিনটি টুকরো দিয়ে এটি নির্মিত। মিহরাবের কুলুঙ্গির কেন্দ্রীয় অংশ শিকল এবং ঘণ্টা নকশায় অলংকৃত। শিকল নকশার পাশে একটি ঝুলন্ত পুতির মালার নকশা ছিল। শিকল নকশার নিম্নাংশে ছিল ঝুলন্ত প্রস্ফুটিত পদ্মের নকশা। পাথরের টুকরাগুলির পার্শ্ববর্তী প্রান্তে গোলাকার এবং বর্গাকৃতির জ্যামিতিক নকশা আছে। মিহরাবের উপর এবং নিম্নভাগে সংযুক্ত গোলাপ নকশা এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এখানে ব্যবহূত শিকল এবং ঘণ্টার নকশার সঙ্গে দরসবাড়ি মসজিদ, ছোটসোনা মসজিদ এবং কুসুম্বা মসজিদ এর শিকল ও ঘণ্টা নকশার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে।
মসজিদের আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা পাথরখন্ডের গায়ে অলংকরণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। এই অলংকৃত পাথরখন্ড প্রমাণ করে যে, মসজিদের বাইরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই করা অলংকরণ ছিল। আলংকারিক অংশগুলি মূলত জ্যামিতিক আকারের ফুলের নকশা, তালপত্র, খোটা (Nailheads), ত্রিভুজাকৃতির, প্যাঁচানো, শিকল ও ঘণ্টার নকশা এবং অর্ধবৃত্তাকার ঝুলন্ত হারের নকশা প্রভৃতি মোটিফ দিয়ে অলংকৃত ছিল। এখান থেকে বেশ কিছু পোড়ামাটির অলংকৃত ফলকের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গম্বুজের ড্রামের অভ্যন্তরে অলংকরণ হিসেবে এই পোড়ামাটির অলংকৃত ফলক ব্যবহূত হয়েছে। অলংকরণের এই পদ্ধতিও দরসবাড়ি, ছোটসোনা এবং কুসুম্বা মসজিদ এ দেখা যায়।
পাল রাজা প্রথম মহীপালের (৯৯৫-১০৪৩) নামানুসারে এই স্থানের নাম মাহীসন্তোষ। এখানে বঙ্গবিজয়ী বখতিয়ার খিলজীর অন্যতম সহযোগী শিরান খিলজী শায়িত আছেন। কথিত আছে, একদিন এক তৃষ্ণার্ত দরবেশ এক স্থানীয় গৃহিনীর কাছে পিপাসা নিবারণের জন্য পানি খেতে চাইলেন, পানি পানের পর সন্তুষ্টচিত্তে তিনি ‘মায়ি সন্তোষ হোগিয়া’ বলে উচ্চারণ করেন; অর্থাৎ ‘মা’ আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। সেই থেকে দরবেশ বাবার মুখে উচ্চারিত কথাটি মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে এই স্থানের নাম ‘মাহীগঞ্জ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কারো কারো মতে, এখানকার পরগনা সন্তোষ জনপ্রিয় রাজা মহীপালের নামের প্রথম অংশের সাথে যুক্ত হয়ে মহীসন্তোষ বা মাহীসন্তোষ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। পঞ্চদশ শতকে সুলতান রুকুন উদ্দীন বারবাকশাহ এখানে বারবাকাবাদ নামের প্রাদেশিক রাজধানী স্থাপন করেন। স্থাপিত হয় টাকশাল, দূর্গ, মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। কিন্তু মুঘল আমলে বিরান ভূমিতে পরিণত হয় সুলতানী আমলের মাহীগঞ্জ। অবশিষ্ট ছিল কেবল রাজস্ব আদায়ের প্রশাসনিক কাঠামো ‘ সরকার বারবাকাবাদ’। লোককাহিনীর বর্ণনা অনুযায়ী এক দরবেশ মাছের পিঠে চড়ে এ স্থানে এসেছিলেন। জনগণের নিকট তিনি ‘মাহীসওয়ার’ (মাহী=মাছ) নামে পরিচিত হন। এ থেকেই স্থানটির নামকরণ হয়েছে। এ বিষয়ে আরও একটি জনশ্রুতি অনুসারে প্রথম মহীপালের (৯৯৫-১০৪৩ খ্রি) নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। স্থানটির সাধারণ নকশা ও কিছু সংখ্যক অস্ত্র-শস্ত্রের আবিষ্কার, বিশেষ করে একটি বন্দুক ও কয়েকটি তরবারি (যা বর্তমানে বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে) নির্দেশ করে যে, মুসলমানদের আগমনের বহু পূর্বেই পরিখা ও কিল্লাসহ এস্থানটি একটি সুরক্ষিত সামরিক চৌকি ছিল। একটি মিহরাব এ লিপি এবং লিপিটির উল্টোদিকে খোদাইকৃত বিষ্ণু ও সূর্যের মূর্তি আবিষ্কার সাক্ষ্য দেয় যে, মুসলমানদের দ্বারা এ অঞ্চল সরকার-এর প্রধান কার্যালয় হওয়ার পূর্বেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে মাহীসন্তোষের অস্তিত্ব ছিল।
বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়ের পর বিজিত অঞ্চলকে কতগুলি ‘ইক্তা’ বা প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করেন। তাঁর অধিনস্থ সেনাধ্যক্ষগণকে ইকতার প্রশাসনিক প্রধান মুক্তা উপাধী প্রদান করেন। বখতিয়ার খলজির আকস্মিক মৃত্যুর পর শীরান খলজিই দেবকোটের মুসলিম শাসক নিযুক্ত হন মসীদা সন্তোষের মুক্তা শীরান খলজি। খলজি বিপ্লব বা আত্মকলহে মাহীসন্তোষে নিহত হলে এখানে সমাহিত হন। পরবর্তীকালে রুকুন উদ্দীন বারবাকশাহ্ (১৪৫৯-৭৪ খ্রিঃ) সন্তোষ পরগণাকে প্রাদেশিক মর্যাদায় উন্নীতি করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বারবাকাবাদ’ সামরিক ছাউনি, টাকশাল, মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতি অসংখ্য ভবন, অট্টালিকায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। টাকশালে মুদ্রিত রুকুন উদ্দীন বারবাকশাহের মুদ্রা ছাড়াও আবু নছর মজাফ্ফর শাহ (১৪৯০ খ্রিঃ) এবং নাসির উদ্দীন নশরৎ শাহের (১৫২১ খ্রিঃ) মুদ্রা আবিস্কৃত হয়েছে। মোগল সামরাজ্রের ১৯টি সরকারের মধ্যে বারবাকাবাদ সরকার ছিল অন্যতম।
এখানে একটি জীর্ণ কামান ও কয়েকটি তরবারি উদ্ধার করা হয়েছে। মাহীসন্তোষ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরণের উপকরণ কলকাতা যাদুঘর, রাজশাহী বরেন্দ্র যাদুঘর ও পাহাড়পুর যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। মাহী সন্তোষে হযরত তকী উদ্দীন আল আরাবীর মাজার ছাড়াও এখানে অনেকগুলো কবর পরিলক্ষিত হয়। সম্ভবত তকী উদ্দীন (রঃ) এর ‘মা’ সহ অপর এক পীরের মাজার, ইয়েমেনের হযরত আশরাফ জাহাঙ্গীর (রঃ)-এর মাজার, বাংলার দ্বিতীয় সুলতান শীরান খিলজি এবং রুকুন উদ্দীন বারবাক শাহের সেনাপতি ইসমাইল গাজীসহ ১২০ জন শহীদ সৈন্যের গণকবর। মাহীসন্তোষের সর্বাধিক গৌরবের বিষয় ছিল ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি। ভারতবর্ষের মুসলিম শাষনের সূচনালগ্ন থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে অগণিত সুফি, দরবেশ, ও আউলিয়ার আগমন ঘটে।
মাহীসন্তোষ গড়ে ত্রয়োদশ শতাব্দির মধ্যভাগে মওলানা তকীউদ্দীন আল আরাবী (রঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাহীসন্তোষের মাদ্রাসাটি প্রথম শ্রেণীর মাদ্রাসায় উন্নীত হয়েছিল। এখানে বখতিয়ার খিলজির বাংলা শাসনকালের শুরু থেকেই ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং এই মাদ্রাসাটি ছিল সমগ্র বাংলার মধ্যে প্রথম ও প্রাচীনতম মাদ্রাসা। তকীউদ্দীন (রঃ) প্রথম দিকে এখানে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, পরে তিনি মাদ্রাসা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাঁর খ্যাতি দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে এসে শিক্ষা লাভ করতেন। মারফত তত্ত্বে এশিয়ার বিখ্যাত হাক্কানী আলেম মখদুমুল-মূলক শায়খ শরফুদ্দীন মানেরীর পিতা ইয়াহিয়া মানেরীসহ প্রখ্যাত আলেমগণ হযরত তকীউদ্দীন আল আবাবীর নিকট শিক্ষাগ্রহণ করেন।
মাহীসন্তোষে তকী উদ্দীন আল আরাবী (রঃ) ছাড়াও অনেক কবর এখানে আছে। বখতিয়ার খিলজি নিহত হওয়ার পর বাংলার দ্বিতীয় মুসলিম শাষক শীরান খিলজির কবর এবং তকী উদ্দীন (রঃ)-এর মা-সহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির কবর এখানেই। এছাড়াও গোরস্থানের মধ্যে একটি চৌদ্দহাত কবর আছে। সম্ভবত এটি একটি গণকবর। কামরূপরাজ পরাক্রমশালী কামেশ্বরের সঙ্গে রুকন উদ্দীন বারবাক শাহের সেনাপতি ইমমাইল গাজীর ভয়াবহ যুদ্ধে ১২০ জন মুসলিম সৈন্য নিহত হয়। এ কবরটি ঐ শহীদদের গণকবর। কথিত আছে, ইসমাইল গাজীর মাহাত্মে ও বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে কামেশ্বর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

Source: Internet


























No comments:

Post a Comment

বালিয়া মসজিদ জ্বীনের মসজিদ  স্থানীয়ভাবে এবং লোকমুখে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘বালিয়া মসজিদ’। জমিদার মেহের বকস চৌধুরী ...