রাসমনি স্মৃতিসৌধ
রাসিমণি হাজং বা রাসমণি (১৯০১ - জানুয়ারি ৩১, ১৯৪৬) ১৯৪৬ সালে সংঘটিত ময়মনসিংহের টঙ্ক আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেত্রী এবং এ আন্দোলনের প্রথম শহীদ। টঙ্ক আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা মণি সিংহের পরেই রাসমনি হাজং এবং কুমুদিনী হাজং-এর অবদানের কথা স্মরণ করা হয়।
রাসিমনি হাজং টঙ্ক প্রথা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। তিনি ছিলেন কৃষক সমিতির বিপ্লবী সদস্য। হাজং নারীদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয় ও নির্ভীক ছিলেন। তাঁর দেখাদেখি অশ্বমণি, কলাবতী, রমমণি প্রমুখ হাজং নারী সংঘবদ্ধ হন। হাজং নারীদের সাহস যোগাতেন রাসমণি। রাসমণি হাজং আদিবাসীদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আসামের অধিবাসী। সুসং রাজ্যের গোড়াপত্তনের পর গারো পাহাড়ের পাদদেশে সুসং জমিদারেরা হাজংদের বসবাসের জায়গা করে দেন। এর কারণ ছিল- এরা অত্যন্ত সৎ, সাহসী, দুর্ধর্ষ এবং বিশ্বস্ত এবং এরা পাহাড়ী গারো ও ব্রিটিশের হামলা প্রতিরোধে এদের ব্যবহার করা সহজ ছিল। ১৯৪৬ সালে ভিয়েতনাম দিবস উপলক্ষে ময়মনসিংহ শহরে মিছিলের উপর গুলিবর্ষণের ফলে একজন ছাত্র নিহত হয়। সমগ্র ময়মনসিংহ জেলায় তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং বহেরাতলী গ্রামে পুলিসের হানায় ত্রাসের সৃষ্টি হয়। ওই দিনই ময়মনসিংহের পুলিশ দপ্তর দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে। বিরিশিরির সেই ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী হাজংদের দমন করার চেষ্টা চালানো হতো। বিভিন্ন গ্রামের হাজং পরিবারগুলো প্রতিদিনই সশস্ত্র বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের শিকার হতো।
টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। ধান হোক বা না হোক জমিদারকে কড়ায় গণ্ডায় ধান দিতে হবে। ১৯৩৮ সালে টংক প্রথার বিরুদ্ধে হাজং সম্প্রদায় ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। হাজং সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধকরণে কুমুদিনী হাজং ও রাসমণি হাজং অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৯ সালে মণি সিংহের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ এলাকায় কৃষকরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে শুরু করেন। গারো পাহাড়ি অঞ্চলে জমিদার, মহাজনদের টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুসারে টংকের ধান জমিদার- মহাজনদের দিতেই হতো। এতে হাজংরা ধীরে ধীরে জমি বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে। তাঁরা এ প্রথা বিলুপ্তির জন্য সংগঠিত হতে থাকে। মণি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৪০ সালে টঙ্ক আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
টংক আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের গ্রেফতার করতে পুলিশ ছিল মরিয়া। পুলিশ বাহিনী বহেরাতলীর আসার সংবাদ পেয়েই লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর তিন ভাই আত্মগোপন করেন টঙ্ক আন্দেলনের প্রবাদ পুরুষ মনি সিংহের গোপন আস্তানায়। লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের ধরতে না পেরে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে লংকেশ্বর হাজং-এর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে রওনা দেয়। রাসমনি ও গ্রামের কৃষক সমিতির কর্মীরা তখন দুর্গাপুরের জনসভা থেকে ফিরছিলেন। খবর পেয়ে সাথে সাথে দিস্তামনি হাজং, বাসন্তি হাজংসহ ১২ জনের একটি মহিলা সশস্ত্র দলসহ রাসমনি অসহায় কুমুদিনীকে উদ্ধারে হাতে থাকা দা দিয়ে পুলিসকে কোপাতে থাকেন। এ সময় পুলিসের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে রাসমনি মারা যান। পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাসমণিকে ধরতে গেলে তাঁকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ বাহিনী। এ ঘটনায় অন্যান্য হাজং নারী-পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সশস্ত্র পুলিশের উপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালান। পুলিশ বাহিনীর দু'জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকি পুলিশ দৌড়ে পালায়।
নারী হয়ে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে জীবন দিয়ে রাসমণি হাজংদের কাছে হাজংমাতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামে তাঁর মৃত্যু সংলগ্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে 'শহীদ হাজংমাতা রাসমণি স্মৃতিসৌধ' যা হাজং বিদ্রোহের অন্যতম সাক্ষী।
রাসমণি একটি নাম, জীবন-সমান দীর্ঘ নাম;
দেশবাসী, জানাও তোমরা তাঁকে সহস্র প্রণাম।
রাসমণি এই বিশাল বাংলায় একবারই জন্মান
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গর্বিত শহীদ।
No comments:
Post a Comment