21 August 2011

Road Safety


সড়ক নিরাপত্তা

মরিনি, তার মানে কি বেঁচে আছি?

আফজাল হোসেন
সকালে উঠেই দেখা হয় সেই হাসি। শিল্পী শিশিরের ব্যঙ্গাত্মক তুলিরেখা দুই চেহারার মালিকদের পরিচয় অস্পষ্ট রাখে না। ঘুম থেকে জেগে প্রথম আলোর প্রথম পাতার সে দ্বৈত হাসি আমাদের দুঃখকে দ্বিগুণ করে। দুঃখ-বেদনাকে অনুসরণ করে আসে ক্ষোভ, হতাশা। বুক ভার হয়ে ওঠে অসহায় অনুভবে। চিলের মতো বড় ডানা মেলে অপরাধবোধ উড়ে আসে। মনে হয়, আকর্ণ বিস্তৃত দুই হাসি অন্য কারও নয়, সে হাসি আমার, আমাদের।
সংবাদপত্রের হেডলাইন ‘সড়ক নিরাপত্তা উপেক্ষিত’। এই নির্মম সত্য জেনে কী প্রতিক্রিয়া জাগে মনে? মৃত্যুর খবর, হত্যার খবর আর আলাদা থাকে না। মানুষ মানুষকে ভাগ করে, ‘আমরা’ ও ‘তোমরা’ হয়ে যায়। ভেদ তৈরি হয়ে যায় মৃত ও মৃত্যুর। মৃত্যু শুধুই শোকের বা ক্রন্দনের নয়। মৃত্যু জীবিতের আত্মোপলব্ধির জন্য। মৃত্যুর খবরে দুঃখের ঘনঘটা, তারপর দিন গেলে নিয়মমতো ভুলে যাওয়ার অভ্যাস। সুখের স্বপ্ন দেখতেও ভুল হচ্ছে না। সবাই নিঃসংকোচ, নির্দ্বিধায় ভাবতে পারছি, বেশ আছি। নানান অস্বাভাবিকতায় সম্পর্কের রং হয়েছে বিবর্ণ। সব ঘটনায় এখন দুঃখ জাগে না। কোনো দুঃখ উপেক্ষায় ম্লান, আবার কোনো দুঃখ খুবই ভারাক্রান্ত করে।
মনে পড়ে, একাত্তরে অজানা কোনো গ্রাম থেকে নদীতে ভেসে আসতে দেখেছিলাম অচেনা এক মানুষের লাশ। পুরো গ্রাম ছুটে এসেছিল নদীর কিনারায়। সে ছুটে আসার কারণ শুধু কৌতূহল ছিল না। মৃত মানুষ ভাসছে নদীতে, এমন ঘটনায় হূদয় বিদীর্ণ হতো। শিউরে ওঠার মতো দুর্বল ছিল তখন মন। কোন গ্রাম থেকে, কার লাশ কেউ জানে না। তখন দুঃসময়, ঘর থেকে বের হওয়া বিপদ, তবু নদীতে ভেসে যাচ্ছে মৃতদেহ—এমন খবরে নির্বিকার থাকতে পারেনি মানুষ। শোকাভিভূত হয়েছিল সাধারণ মানুষেরা।
এই অনুভূতি, সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশের আগ্রহ বদলেছে। অস্বাভাবিক মৃত্যু এত নিয়মিত যে, মন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শিখে গেছে। খবর এ-কান দিয়ে ঢুকে ও-কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। বিজ্ঞানযুগে দেখানোর চেষ্টা নিয়ে মাতামাতি রয়েছে বলে না দেখার উপায় থাকে না। সে দেখা, সে অন্যায়, করুণ পরিণতি চোখ থেকে মুছে যেতেও সময় লাগে না।
মানুষকে পিটিয়ে মেরে বীরত্ব অর্জন করছে মানুষ। কে কাকে মারছে? রক্তের সম্পর্ক না হোক, এক অঞ্চলে পাশাপাশি পরিবারে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, মানুষটা অপরিচিত নয়, এ-ও তো একধরনের সম্পর্ক। চেনা মানুষকে চেনা মানুষ হত্যা করে, হাত কাঁপে না। এত বদলে গেছে জীবন।
খাদে পড়ে গাড়িভর্তি স্কুলছাত্রের মৃত্যু। এমন খবরে আগের মতো শিহরণ নেই। রোমকূপের গোড়া খুব সহজে শক্ত হয় না, গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায় না। দুদিন চর্চা চলে বলে মনে খবরটা ঘুরপাক খায়, মিলিয়ে যাওয়ার সময় হলে মিলিয়ে যায়। মনেরও তো জমিয়ে রাখার নির্দিষ্ট আয়তন রয়েছে। একটা মুছে যায় বলে অন্যটার জায়গা পেতে অসুবিধা হয় না।
ছাত্রদের ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার খবর আসে। শোনার অভ্যাসে শোনা হয়। অনুভূতির মধ্যে হতাশা একটু এপাশ-ওপাশ করে। ব্যস, ওটুকুই। তারপর নতুন খবরের জন্য আবার অপেক্ষা। অপেক্ষা শব্দটা হয়তো এখানে মানানসই নয়, আপত্তিকর কিন্তু প্রতিনিয়ত মানুষ এবং মৃত্যু যে উপেক্ষিত হচ্ছে, কে অস্বীকার করবে তা?
ফুটপাত দিয়ে মানুষ হাঁটছিল, ওপরে চলছে নির্মাণকাজ। সতর্কতা, সাবধানতার ব্যবস্থা নেই, ইট পড়ে মানুষের মৃত্যু। সাদামাটা খবর। লিফট ছিঁড়ে শ্রমিকের মৃত্যু, এ খবর মাত্র দুই দিনের আলোচনায় টিকে থাকে। সাধারণের মৃত্যুর খবর ধার ও ভারের অভাবে মনে তেমন রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটায় না।
গণপিটুনিতে নিহতের খবর আসে। সে খবরে নতুন আকর্ষণ যোগ করে চিত্রনাট্য। যারা রক্ষা করবে, তারাই জনতার রোষানলে ঠেলে দিয়েছে অসহায় একটা জীবিত মানুষকে।
জীবন অতি মূল্যবান। কোনো জীবনের অতি মূল্য, কোনো জীবন মূল্যহীন—এমন বিবেচনা জীবিত মানুষের। জীবিতদের নানান হিসাব-নিকাশের সময়-সুযোগ থাকে। কম দুঃখ পায়, বেশি দুঃখ পায়। হিসাব কষে নির্দিষ্ট করে শোকের পরিমাণ। ক্ষোভ, ক্রোধ, কর্তব্য, দায়িত্ব—সবই উপেক্ষায় নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে।
প্রেসক্লাবের সামনে সেদিন মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। আবিদ শাহরিয়ার, মুত্তাকিন মাহবুব আর আশিক মুস্তফা—এই তিন উজ্জ্বল তরুণের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সমুদ্র। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য দুর্ঘটনার কথা আগে জানা হয়েছে, সেসব অন্য মানুষের মৃত্যু বলে গভীর হয়ে মনে দাগ কাটেনি। অপরিচিতের অজুহাত আছে কিন্তু সে সব তো মৃত্যুই ছিল। মৃতের প্রতি উপেক্ষায় বেঁচে থাকার সম্মান থাকে না।
অস্থিরতা ঘুমুতে দেয় না, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ তাড়িয়ে বেড়ায়। কোন উদ্যোগ এবং চেষ্টায় এমনতর মৃত্যু রোধ করা যাবে, সমব্যথীরা একত্র হয়ে ভাবা হয়। এক শ রকম নিরাপত্তার বিবেচনা ঘুরপাক খায় মাথায় মাথায়। এমনতর ভাবনা আগে ভাবিনি, ভাববার প্রয়োজন হয়নি। দূরের জনের মৃত্যু দূরেই থেকেছে। এ কি উপেক্ষা নয়?
এই ভাবনা, আত্মোপলব্ধিতে যখন মন জর্জরিত, তখন আর এক ভয়ংকর দুঃসংবাদে সবাই আরও এক দফা ঝাঁকি খেয়ে নুয়ে পড়ে। সবাইকে দুমড়েমুচড়ে অসহায় করে দেয়।
এমন দুর্ঘটনার খবর আগে আমাদের কানে বহুবার এসেছে, আপন মানুষ না হলে আমাদের চমকানোর অভ্যাস নেই। এহেন অন্যায় চরিত্রকে চেনানোর জন্যই যেন এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। নিজেদের মিথ্যা অস্তিত্বকে অনুভবের জন্যই প্রিয় মানুষদের এই মৃত্যু। যেন সর্বশক্তিমানকে শেষ পর্যন্ত বিব্রত হয়ে বোঝাতে হচ্ছে, ‘সাধারণ মৃত্যুতে তোমাদের টনক নড়ছে না, নাও, তাহলে যা চাও, তা-ই দিলাম তোমাদের’।
কীভাবে অস্বীকার করব এমন মৃত্যু আমরা চাইনি? প্রিয় মানুষদের মৃত্যুর পর তারস্বরে বলছি, চাইনি। চাই না বলে হাতে হাত ধরে আমরা তো দাঁড়াইনি। অন্যায় সব মৃত্যু রুখতে হবে বলে তো একত্র হইনি। অন্যায্যর বিরুদ্ধে দৃঢ় হতে পারিনি।
বেঁচে থাকাটা যে মানুষের ন্যায্য অধিকার, সেই অধিকারের তোয়াক্কা কে কতটুকু করেছি? কে কবে এমন মৃত্যুতে কতখানি উদ্বিগ্ন হয়েছি? সময়গুলো যদি যোগ করি, মৃত তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের জন্য যতখানি সময় আমরা হাসপাতাল, শহীদ মিনার বা মসজিদে কাটিয়েছি, তার শত ভাগের এক ভাগ সময় কি প্রতিকারে দিয়েছি? বিহ্বল মনে প্রশ্ন জাগে।
মৃত্যুর মতোই আমাদের দুঃখ-কষ্ট, অনুতাপ সত্য কিন্তু সে নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয়ে জানা হয়েছে, যেকোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার হতে পারতাম। মৃত্যু আপন কারও নয় ভেবে যথেষ্ট উপেক্ষা দেখিয়ে অজস্র পাপ জড়ো হয়েছে। অসংখ্য অবহেলার দায় নিজেদের ঘরের দরজায় এসে ঝড়ের বেগে ধাক্কা দিতে ঘুম থেকে জেগে নড়েচড়ে বসেছি সবাই। সেদিন শহীদ মিনারে শোক শেষে মানুষের ঢল কফিনদ্বয় অনুসরণ করে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে, জানাজায়। চ্যানেলে চ্যানেলে স্বজন হারানোর শোক। মনে হচ্ছিল, এত দিনে জেগেছে অন্তর্দৃষ্টি, চেতনা ফিরেছে সবার। ঘটনার পরম্পরায় মনে আশা জেগেছে, জুটেছিল সান্ত্বনা। সেই সান্ত্বনা অতি ক্ষণস্থায়ী, খুবই ঠুনকো।
উপেক্ষা ও অবহেলার যে নির্মম অভ্যাস রপ্ত হয়েছে, তা থেকে মুক্তি কবে? কাছের জনের মৃত্যুতে কাছের মানুষেরা কাঁদছে। সেই কান্নায় রাস্তার ভয়ংকর রূপ, মানুষের বেপরোয়া স্বভাব এতটুকুও বদলায়নি।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর কী অসামান্য প্রতিভা ছিলেন, সেই হাজার প্রকার ব্যাখ্যায় এখন কার কী যায়-আসে? অপূরণীয় যে ক্ষতি হওয়ার, হয়ে গেছে। জীবিতরা মৃতের জন্য হাহাকার করে, তাতে মৃতের কোনো উপকার নেই। অস্থিরতা, কষ্ট, দীর্ঘশ্বাস জীবিত মানুষদের। দুঃখের ভার থেকে মুক্ত হতে হয় জীবিত মানুষকেই।
আমরা মৃতের জন্য যখন শোক প্রকাশ করি, সেই শোক কোন ঠিকানায় যায়? এ ধরায় নামহীন উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে নিজেদের কাছে ফের ফিরে আসে। জীবিতের শোক ফেরত আসে জীবিতের কাছেই। অতএব শ্রেয়তর হচ্ছে নিজেদের জন্য নিজেদের শোক। তাহলে নিজেদের উপেক্ষা, স্বার্থপরতা স্বীকার করে অপরাধবোধের ভার কমানো যায়। আমরা মরিনি, তার মানে কি বেঁচে আছি?
পুনশ্চ: প্রিয়জন হারানোর শোকে ভুলের পরিমাণ যেন নতুন করে না বেড়ে যায়। হারাতে হারাতে হারাইনি এমন মানুষের প্রতি অবহেলা, উপেক্ষায় শোকের পরিধি আর যেন না বাড়ে।
একই দুর্ঘটনার শিকার প্রতিভাধর তরুণ শিল্পী ঢালী আল মামুন এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। বেঁচে থাকা মানুষেরাই তাঁকে সেই লড়াইয়ে জেতাতে পারে। মৃতদের আত্মার শান্তির জন্য জীবিতরা শুধু প্রার্থনা করতে পারে কিন্তু যে মানুষকে মৃত্যু ও জীবন দুই দিক থেকে টানছে, তাঁর জন্য জীবিতদের অনেক কিছু করার আছে।
আফজাল হোসেন: লেখক, অভিনেতা, বিজ্ঞাপনচিত্র-নির্মাতা।
afzalhossain1515@yahoo.com

Source:

No comments:

Post a Comment

বালিয়া মসজিদ জ্বীনের মসজিদ  স্থানীয়ভাবে এবং লোকমুখে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘বালিয়া মসজিদ’। জমিদার মেহের বকস চৌধুরী ...