16 August 2011

যে দেশে জীবন জিয়ে না

যে দেশে জীবন জিয়ে না

ফারুক ওয়াসিফ
আগে কাউকে দেখলে বলতাম, ‘কেমন আছেন?’ এখন বলি, ‘বেঁচে আছেন?’ বিদায়ের সময় ‘ভালো থাকবেন’ বলি না; বলি ‘বেঁচে থাকবেন!’ ভালো না থাকি, বেঁচে যেন থাকি। আমাদের সময়ের নায়কেরা সময়কে ধাক্কা দিয়ে চলে না যাক। কচি শিশুরা দল বেঁধে মারা না পড়ুক। বন্ধুরা সমুদ্রে ডুবে লাশ হয়ে না ফিরুক। ছোট ভাইয়েরা বেড়াতে গিয়ে গণপিটুনিতে থেঁতলে না যাক। ফুটপাতে মাথার ওপর ইট খসে পড়ে মৃত্যু অনিবার্য বলে মানা না হোক। অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে হাসপাতালে কারও মৃত্যু দেখতে না হোক। আমাদের তরুণেরা থানাহাজতে বা ক্রসফায়ারে মারা না পড়ুক, পঙ্গু না হোক। অনিয়ম-অপমান সয়েও আমরা বাঁচতে চাই, এত অপঘাত মানা সম্ভব নয়।
কাছের কেউ, প্রিয় কেউ মারা গেলে আমাদের জীবনের একটি অংশও তাদের সঙ্গে চলে যায়। আমরা কিছুটা খাটো হয়ে পড়ি, আমাদের জীবনও যেন কিছুটা ফুরিয়ে যায়। জলজ্যান্ত মানুষগুলো হঠাৎ বিদায় নেওয়ায় সে রকমই লাগছে। এখন বাসভর্তি মানুষ, গাড়িভর্তি মানুষ, রাস্তা পেরুনো মানুষ, ফুটপাতের মানুষ, এমনকি নিজেকেসহ আশপাশের মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি—আজ আছি, কাল থাকব তো? গত কয়েক মাসে ধাক্কার পর ধাক্কা কেবল; যতই ছড়িয়ে পড়ছে মৃত্যু, ততই আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে। মানুষ মনের মধ্যে অসহায় বোধ করছে। হাহাকার ছাপিয়ে শোকসভাগুলোতে শোনা যাচ্ছে প্রতিবাদ। মৃত্যুগুলো আমাদের জিন্দা লাশ বানিয়ে দিচ্ছে, আধমরা করে রাখছে। পূর্ণমৃতদের প্রতি কীভাবে তাহলে শোক জানাব এই অর্ধমৃতরা? মরার দেশে জীবন জিয়ে না।
এ দেশের ইতিহাসে অপঘাতের দীর্ঘ সারি। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরই কি প্রথম? চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরও অপঘাতে মারা গেছেন। অপঘাতে শহীদ জহির রায়হানের লাশটাও মেলেনি। হুমায়ুন আজাদও বাঁচতে পারেননি। অপঘাত থামিয়ে দিয়েছিল চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনকেও। কদিন আগে সমুদ্রে ডুবে মারা গেলেন তিন শিল্পী। তাঁরা কেউই তাঁদের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন যাঁর যাঁর ক্ষেত্রের দিশারি। জীবনের পথ তৈরি করছিলেন যাঁরা, তাঁদের পথই হঠাৎ বাঁক নিয়ে সমাধিক্ষেত্রের দিকে চলে গেল। তারেক ও মিশুক অনেক দিয়েছেন, কিন্তু জীবনের মধ্যগগনে ডুবে যাওয়া সূর্যের থেকে বড় অপচয় আর কী হতে পারে? অসমাপ্ত সংগীতের বেদনা, অসাধিত স্বপ্নের হতাশাই কি আমাদের জাতীয় জীবনের প্রধান আবহসংগীত?
শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা হাজারো মানুষের মুখে শুধু শোক নয়, আরও কিছু যেন ফুটে উঠছিল। সেটা কি শোকের পাথরে ঠিকরানো ক্ষোভ? একা থাকলে হতাশা, ভয় ও রাগ কুরে খাবে বলে জীবিত সবাই অন্য জীবিতদের দেখতে এসেছেন? শোকের সংহতির মধ্যে একটি সময়, একটি যুগ, একটি আহত মন সেখানে যেন বোবা হয়ে ছিল।
সব মৃত্যুই সমান মর্মান্তিক। সব শোকই অসহনীয়। যাঁর জীবন যায়, তাঁর সবই যায়। যাঁরা স্বজন হারান, তাঁদের জীবনের আলো কমে আসে। সব কান্নাই নোনা ব্যথার। সব মৃত্যুই মানবতার। ইংরেজ কবি জন ডানের কথায়, ‘যে কারও মৃত্যুই আমাকে খালি করে দিয়ে যায়। কেননা, আমি মানবতারই একজন। কার জন্য ঘণ্টা বাজে জানতে লোক পাঠিও না, ঘণ্টা তোমার জন্যই বাজে।’ তারেক-মিশুকদের মৃত্যুর মধ্যে তাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আরও হাজার হাজার মানুষের বিপর্যয়ই দেখি। একই দিনে পাবনায় মারা গেছেন আরও পাঁচজন। মৃত্যু খ্যাত-অখ্যাতদের এক করে দিয়েছে। কেউই আর নিরাপদ নই।
সড়কগুলো অপঘাতের জন্য সদা প্রস্তুত। যানবাহন দুর্ঘটনামুখী, চালকেরা বেপরোয়া। দেখার কেউ নেই, ব্যবস্থা নেই, শাস্তি নেই। নৌমন্ত্রীর অনুরোধে যোগাযোগমন্ত্রী সাড়ে ২৪ হাজার অযোগ্য লোককে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছেন। অতীতের রেকর্ডও তথৈবচ। সবকিছু ভেঙে পড়লেও তাঁদের সাফাইয়ের কোনো অভাব হয় না। যাঁদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং, বেশির ভাগই হাতুড়ে; নিয়মকানুন অমান্য করার অভ্যাস তাঁদের মজ্জাগত। তবু তাঁরা লাইসেন্সধারী। যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, চালাচ্ছেন একেকটি মন্ত্রণালয়, তাঁদেরও আছে ক্ষমতার লাইসেন্স।
লাইসেন্স কার নেই? লাইসেন্স করা বা পাওয়া কঠিন নয় দুর্নীতির ছায়ায়। কিন্তু গাড়ির চালক থেকে দেশের চালকেরা সবাই এ রকম সেন্সলেস হয়ে গেলে জীবন থমকে দাঁড়ায়। এই মৃত্যু উপত্যকা আমাদের দেশ না; আমরা এখন জীবনের লাইসেন্স চাই।
দুর্ঘটনাগুলো ভাগ্যের লিখন নয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১২ হাজার মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। অর্থাৎ প্রতি ৪৫ মিনিটে একজন। আহত হয় ৩৫ হাজার, এদের অনেকেরই অঙ্গহানি ঘটে যায়। এত মানুষের মৃত্যু কেবল যুদ্ধেই ঘটে থাকে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের সড়কগুলো বিপজ্জনক তালিকার শীর্ষে। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে দুর্ঘটনার হার ৮৫ দশমিক ৬টি। মিয়ানমারে তা ৪৭ দশমিক ৭, নেপালে ৬২ দশমিক ৭। ধনী দেশগুলোতে যেখানে যানবাহনের সংখ্যা শতগুণ বেশি, সেখানে এই হার মাত্র ৩।
এ অবস্থা তো প্রাকৃতিক নিয়মে হয়নি। অবহেলা, সুবিধাবাদ, দুর্নীতি আর দায়িত্বহীনতা প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। ঈদের আগে বেশ কটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে আছে। কদিন পরে ঘরমুখো মানুষকে কী যন্ত্রণা পোহাতে হবে, যোগাযোগমন্ত্রী কি তা জানেন না? খোদ যমুনা সেতুর ফাটল বছরের পর বছর সংস্কারহীন থেকে যায়। নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে এ অবস্থা।
অবস্থাটা পরিকল্পিত না হলেও গাফিলতিটা সচেতন কর্মফল। এটাই সমাজ-রাষ্ট্রের কাঠামোর সমর্থনে অপঘাত ঘটাচ্ছে আর মানুষ মরছে। সবকিছু ভেঙে পড়ছে, তার তলায় চাপা পড়ছে মানুষের জীবন। এসব মৃত্যুকে তাই দুর্ঘটনা না বলে বলতে হয় স্ট্রাকচারাল কিলিং বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, জামাল হোসেন, ওয়াসিম, গাড়িচালক মোস্তাফিজুর রহমানসহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকেই এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের শিকার।
উচ্চমহলে নিষ্ঠুর উদাসীনতা। এদিকে আত্মপরতার পিচ্ছিল ঢাল দিয়ে গড়াতে গড়াতে ‘আম’-রাও চলছি পতনের দিকে। আমাদেরও লাগানো হচ্ছে অপঘাতে, গণপিটুনিতে। নৈরাজ্যের লক্ষণ আমাদের আচরণে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সবাই সবাইকে ওভারটেক করতে চাইছি, অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি, নিয়ম ভাঙছি। সবাই মরলেও আমি বেঁচে যাব—এমন অদ্ভুত নিয়তিবাদ তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রতিবাদ নেই, সুবিধাবাদ আছে, পলায়ন আছে।
এই পোড়ার দেশে কিছুই তাই দাঁড়ায় না। কম মানুষই যাত্রা শেষ করতে পারে। তার আগেই মৃত্যু এসে নিয়ে যায়। বিকাশের ধারা অজস্র যতিতে ছন্নছাড়া। নৈরাজ্য, অপঘাত, আত্মঘাত আর অবসাদে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমরা। আশার সমাধিতে তবু আমরা অপেক্ষা করি।
ইংরেজ আসার আগে, সতেরো শতকের গোড়ার দিকে এ রকম এক নৈরাজ্য বঙ্গদেশকে গ্রাস করেছিল। সে সময়ের পটে লেখা অমিয়ভূষণ মজুমদারের মধুসাধু খাঁ উপন্যাসে একটি কথা ছিল, এ রকম অবস্থায় ‘পুরুষ জীয়ে না’। নারীও জিয়ে না। এই দেশে এখন জীবন জিয়ে না। অনেক মানুষ অকালপ্রয়াত হয় তখনই, যখন কালটাই অকাল হয়ে যায়। এই অকালে অপঘাতের প্রতীক্ষাই হয়তো আমাদের জীবন।
শোকের মাতম তোলাই যেন আমাদের দায়সারা দায় পালন। মৃত্যুর উদ্যাপন দিয়েই আমরা বুঝি—‘বেঁচে ছিলাম’।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments:

Post a Comment

বালিয়া মসজিদ জ্বীনের মসজিদ  স্থানীয়ভাবে এবং লোকমুখে জ্বীনের মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদটির প্রকৃত নাম ‘বালিয়া মসজিদ’। জমিদার মেহের বকস চৌধুরী ...